প্রতিকূলতা থেকে সাফল্যের শিখরে: শাহাদাত হোসেন খোকনের জীবন সংগ্রাম
রাজিব মাসুদ : শাহাদাত হোসেন খোকন, এক অদম্য সংগ্রামী নাম। জীবনের শুরু থেকেই প্রতিকূলতা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। দারিদ্র্য, পারিবারিক কলহ আর অনিশ্চয়তার মাঝেও তিনি হার মানেননি, বরং প্রতিটি বাধাকে অতিক্রম করে পৌঁছেছেন সাফল্যের শিখরে। ফেনী নবী রেষ্টুরেন্ট এন্ড বিরিয়ানি হাউসের একজন সাধারণ গ্লাস বয় থেকে হয়েছেন সেই হোটেলেরই সিনিয়র ম্যানেজার।
নোয়াখালি জেলার সদর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের মোহাম্মদ ইস্রাফিলের ছোট ছেলে শাহাদাত হোসেন খোকন। তাঁর বাবা তাঁর ভাইদের তুলনায় কিছুটা দরিদ্র ছিলেন। পৈতৃক সম্পত্তি নিয়েও চলেছিল জোরপূর্বক দখল। এমন এক প্রতিকূল পরিবেশে শাহাদাতের জন্ম। পরিবারের ছোট ছেলে হওয়া সত্ত্বেও মাত্র ৯ বছর বয়সে তাঁকে মানুষের বাড়িতে কাজ নিতে হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কাজের তুলনায় বেতন কম হওয়ায় তিনি মুদি দোকানে কাজ নেন। সেখানেও বঞ্চনার শিকার হয়ে নোয়াখালী ছেড়ে ফেনীতে চলে আসেন।
ফেনীতে এসে দিশেহারা শাহাদাত অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছান নবী রেষ্টুরেন্ট এন্ড বিরিয়ানি হাউসে। সেখানে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তিনি গ্লাস বয়ের চাকরি নেন। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে দ্রুতই তিনি নবী রেষ্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের আস্থা অর্জন করেন। দিনের বেলায় হোটেলের কাজ করার পাশাপাশি রাতের আঁধারে সিএনজি চালিয়েছেন অতিরিক্ত আয়ের জন্য। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছর তিনি নবী রেষ্টুরেন্টে বিভিন্ন দায়িত্বে কাজ করেছেন।
২০০৯ সালে হঠাৎ তিনি চট্টগ্রামে চলে যান এবং কিছুদিন পর সাবেক বাংলাদেশ বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী নাসিরুদ্দীনের ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে নিযুক্ত হন। মন্ত্রীর ড্রাইভার হিসেবে কয়েক বছর কাজ করার পর ২০১২ সালে আবারও তাঁর মন টানে নবী রেষ্টুরেন্টর দিকে। নবী রেষ্টুরেন্টের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মায়া তাঁকে মন্ত্রীর আরামদায়ক চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে।
২০১২ সালে তিনি নবী রেষ্টুরেন্টে ফিরে আসেন এই আশায় যে আবারও সেখানে কাজ করবেন। নবী রেষ্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ তাঁর ফিরে আসায় অবাক হন এবং তাঁর সততা ও নিষ্ঠার প্রতি বিশ্বাস রেখে তাঁকে সরাসরি সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেন। ২০১২ সাল থেকে তিনি সাফল্যের সাথে নবী রেষ্টুরেন্টের সিনিয়র ম্যানেজার পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
তবে, ব্যক্তিগত জীবনে শাহাদাত হোসেন খোকনকে আরও কিছু কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ২০২২ সালে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি তাঁর বোন লাইলি বেগমকে হারান এবং ২০২৪ সালে অসুস্থ হয়ে মারা যান তাঁর মা নূর নাহার সুন্দরী। তাঁর বাবা মোহাম্মদ ইস্রাফিল এখন মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় বেঁচে আছেন।
শাহাদাত হোসেন খোকনের জীবন যেন এক জলন্ত উদাহরণ—কিভাবে প্রবল প্রতিকূলতার মাঝেও অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে একজন মানুষ সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করতে পারে। নবী রেষ্টুরেন্টের একজন সাধারণ গ্লাস বয় থেকে ম্যানেজার পদে তাঁর এই যাত্রা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক।